নামাজ পড়া শেষ।
আকাশে আধখানা নিয়তির মতো চাঁদ
একটা সাদা এম্বাসেডর এসে দাঁড়াল কাল্লুর ঝুপড়িতে
‘জয় শ্রীরাম’
কাল্লু বলল- ‘জয় শ্রীরাম’।
ওরা তিনজন ছিল।
“কাল্লু মন দিয়ে শোন্,
কাল ভোরবেলা তোর অ্যাকশন
এই নে, এটা রাখ তোর কাছে”
বলেই একটা মোবাইল ধরিয়ে দিল।
এ তল্লাটে লোকে ডাকে ‘কাটা কাল্লু’
পাঁচ বছর আগে ওয়াগন ভাঙতে গিয়ে
ডান হাতটা কাটা পড়েছিল কাল্লুর
সেই কাটা হাত মাটি থেকে তুলে নিয়ে দৌড়েছিল
‘জয় শ্রীরাম’
হাতে ত্রিশুল, খাকি হাফ প্যান্ট, কোমরে গেরুয়া, মাথায় গেরুয়া।
ভোর চারটেয় মোবাইল বাজল—
“উঠে পড় কাল্লু, সূর্য ওঠার আগে তোকে উঠতে হবে,
কাক ডাকার আগে তোকে উঠতে হবে,
তোর ছেলেদের ডাকতে হবে,
মুরগি ডাকার আগে তোকে বলতে হবে
‘জয় শ্রীরাম’।
শোন্, ভুলে যাস না
পাঁচ বছর আগে তোর হাত কেটে নিয়েছিল যে জিআরপি
তার নাম- ইকবাল
তোর অ্যাকশন শুরু আর এক ঘণ্টার মধ্যে
স্পটে গেলেই তুই সব পেয়ে যাবি
কেরোসিন, পেট্রোল, লোহার রড,
আর একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ
আর এক দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে পার্টির ছেলেরা
পার্টির ছেলেদের থেকে আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে
প্রশাসন, জিপ, রেডলাইট এমবাসেডার
এসব দাঁড়িয়ে থাকার মানে তোকে বুঝতে হবে না
তুই এগিয়ে যা, আমরা আছি
তিন মাস ধরে আমরা এটা ছকে রেখেছি
যা এগিয়ে যা, আজ তোর দিন, হাত কেটে নে
তোর একটা হাত কেটেছিল যারা
তাদের একশোটা হাত কেটে নিয়ে লড়িতে তুলে দে, ঘর পুড়িয়ে দে
তুই তো খারাপ কাজ করছিস্ না, তুই করছিস্ দাঙ্গা
আবার বল ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয় শ্রীরাম’।
এরপর কাল্লু আর মানুষ ছিল না
এরপর কাল্লু আর কাল্লু ছিল না
এরপর কাল্লু আর কেউ ছিল না
কাল্লু পেট্রোল হয়ে গড়িয়ে গেল
কাল্লু লোহার রড হয়ে ঘুরে বেড়াল
এক ঘণ্টার মধ্যে গোটা একটা পাড়াকে নরক বানিয়ে
নরকের বাইরে বেরিয়ে এল কাল্লু।
তার দলের ছেলেরা তখন গলায় ঢালছে বোতল
একটা বোতল এগিয়ে দিল কাল্লুর দিকে
কাল্লু বলল, “তোরা তো জানিস্
অ্যাকশনের সময় আমি এসব ছুঁই না”।
কাল্লু চোখ ভরে দেখল একটা গোটা পাড়া জ্বলছে দাউ দাউ করে।
শিমুল গাছের নিচে এসে দাঁড়াল কাল্লু
“কে রে গাছের পেছনে, কে ওখানে? কে কাঁদছে?”
এক ঝটকায় ধরে ফেলল চুড়িপরা হাতটাকে
“কে তুই?”
একটা বারো তেরো বছরের মেয়ে
নতুন একটা ঘাগরা পরা
নতুন চুড়ি, চোখে চশমা, হাতে একটা হ্যারিপটারের বই।
কী সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে!
—একটা গোটা মেয়ে।
কাল্লু চিৎকার করে উঠল— “তুই এখানে কেন?
এখানে তুই কী করছিস্? তুই কে?”
মেয়েটা বলল, “আমি রুকসানা”
“তুই কে?”
“আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি”
“তুই কে?”
“আমার মা-বাবা ঐ আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে,
ওদেরকে একটু বের করে নিয়ে এসো না।”
“বলে কী মেয়েটা, এই শালা জানিস না —
আমি মারতে পারি, বাঁচাতে পারি না”।
ততক্ষণে কাল্লুর ছেলেরা এসে কাল্লুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে
“গুরু, কী সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে! একটা গোটা মেয়ে”
কাল্লু তাকাল তার দলের দিকে
প্রত্যেকটা মুখ আগুন
প্রত্যেকটা মুখ মদ
প্রত্যেকটা মুখ খুন
সবচেয়ে মদ খেয়েছে যে মুখটা সে বলল—
“গুরু, ফিফ্টি ফিফ্টি, তুমি একবার আমি একবার;
চলো, আজ একটাও রেপ করিনি, এবার করতে দাও”।
কাল্লু সপাটে একটা চড় মারল, বা হাতের চড়ে
ছেলেটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে
কাল্লু মেয়েটাকে আপাদমস্তক দেখল—
হাতে চুড়ি, নতুন ঘাঘরা, চোখে চশমা,
হাতে এক মিনিট আগেও ছিল হ্যারিপটার
ওর নিজের মেয়েটা বেঁচে থাকলে সেও ক্লাস সেভেনে পড়ত
তার হাতে এরকম একটা বই থাকত
তার হাতেও এমন চুড়ি থাকত
কাল্লু চিৎকার করে উঠল, “তুই এখনো বেঁচে আছিস কেনো?
তুই মরে যাসনি কেন মা?
পেছনে জ্বলছে ঘরবাড়ি
সামনের রাস্তায় জ্বলছে তিনটে মারুতি ভ্যান
একটা গাছের তলায় নতুন ঘাঘরা পরা এক কিশোরী।
কাল্লু কোলে তুলে নিল মেয়েটাকে
মেয়েটা চিৎকার করছে, দু’হাত দিয়ে মারছে কাল্লুকে
“মা কোথায়, মা কোথায়, আমার বাবা কোথায়?”
কাল্লু বলছে, “বেটি চুপ কর, চুপ কর, রো মাত”।
কাল্লুর দলের ছেলেরা হাঁ,
হচ্ছেটা কী বুঝতে পারছে না
ওরা ছ’জন ঘিরে ধরে কাল্লুকে, কাল্লু মাঝখানে
মার্ মার্, মার্ ওকে, মার্
কাল্লু ওদের মেরে মাটিতে ফেলে দেয়
কাল্লু দৌড় দেয়, মেয়েটিকে কোলে নিয়ে দৌড়োয়
পেছন থেকে তার দলের ছেলেরা তাকে বলে—
“গুরু, তুমি একাই খাবে? আমাদের দিয়ে খাবে না?”
কাল্লু পেছন ফিরে দাঁড়ায়, তারপর থুঃ করে থুথু দিয়ে দৌড়োতে থাকে
নদীর ধারে এসে দাঁড়ায়
নদী থেকে আজলা ভরে জল তুলে মেয়েটির চোখে মুখে দেয়।
মেয়েটি বলে, “আমার মা কোথায়? আমার বাবা কোথায়?”
মেয়েটি পালাতে থাকে
মেয়েটি কাল্লুর থেকে পালাতে থাকে
কাল্লু ধমকে ওঠে, “চুপ শালা!
আজ থেকে আমিই তোর বাবা, আমিই তোর মা”।
ঠিক তক্ষুণি বেজে ওঠে মোবাইল
“কী রে কাল্লু, কী করছিস্ মেয়েটাকে নিয়ে?
এখনো সময় আছে, নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দে”।
কাল্লু মোবাইলটাকে এক কান থেকে আরেক কানে এগিয়ে বলে—
“আমি পারব না”।
“কী হচ্ছে কাল্লু, ওকে রেপ করে ছুঁড়ে ফেলে দে”।
কাল্লু কান থেকে মোবাইল ফোন নামিয়ে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
তারপর আবার দৌড়…
দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৌড়…
কাল্লু কোথায় যাবে জানে না
কাল্লু কী খাবে জানে না
কাল্লু কী খাওয়াবে তাও জানে না
শুধু জানে তাকে দৌড়াতে হবে মেয়েটিকে নিয়ে
সে এতদিন মানুষ মেরেছে
আজ প্রথম সে কাউকে বাঁচাতে চাইছে
দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৌড়…
একজনকে বাঁচানো এত আনন্দের!
কাল্লুর পেছনে জয় শ্রীরাম
কাল্লুর পেছনে পুলিশ
কাল্লুর পেছনে পার্টির লোক
কাল্লুর পেছনে প্রশাসন
কাল্লুর বাড়ি পুড়ছে
কাল্লুর বউ ঘরছাড়া
কাল্লুর নামে হুলিয়া
কাল্লু দৌড়োয়, নদী পেরোয়, ধানক্ষেত পেরোয়, জলা পেরোয়,
ন্যাশনাল হাইওয়ে, এক ট্রাক থেকে অন্য ট্রাকে
এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেন
কাল্লু জানে — সে গুজরাট ছাড়িয়ে, বিহার ছাড়িয়ে
একদিন কলকাতায় এসে দাঁড়াবে
চোখে চশমা, হাতে হ্যারিপটার, পিঠে স্কুলব্যাগ নিয়ে
হাতে জলের বোতল ঝুলিয়ে
একদিন মেয়েটাকে স্কুলবাসে তুলে দেবে।
আর সে হাজার হাজার ফুচকাওয়ালার মতো
ময়দানে লাল-নীল ফোয়ারার পেছনে
সপ্তষীমণ্ডলের নিচে দাঁড়িয়ে
ফুচকা বিক্রি করবে।