মুক্তিযুদ্ধের কবিতা 

আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,
শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,
ঘুমিয়ে পোড়ো না, কথা ব’লেও নষ্ট কোরো না এই রাত্রি-
শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।

কেন না কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হ’য়ে গেছে,
কোনো উক্তি নির্মল নয় আর, কোনো বিশেষণ জীবন্ত নেই;
তাই সব ঘোষণা এত সুগোল, যেন দোকানের জানালায় পুতুল-
অতি চতুর রবারে তৈরি, রঙিন।

কিন্তু তোমরা কেন ধরা দেবে সেই মিথ্যায়, তোমরা যারা সম্পন্ন,
তোমরা যারা মাটির তলায় শস্যের মতো বর্ধিষ্ণু?
বোলো না ‘সুন্দর’,বোলো না ‘ভালোবাসা’,
উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলো না নিজেদের- শুধু আবিষ্কার করো, নিঃশব্দে।

আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই,
যার উপর দিয়ে বাতাস ব’য়ে যায় চিরকালের সমুদ্র থেকে,
যার আকাশে এক অনির্বাণ পুঁথি বিস্তীর্ণ-নক্ষত্রময়, বিস্মৃতিহীন।

আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়।
দেখবে কেমন ছোটো হ’তেও জানে সে, যেন মুঠোর মধ্যে ধ’রে যায়,
যেন বাহুর ভাঁজে গহ্বর,যেখানে তোমরা মুখ গুঁজে আছো
অন্ধকারে গোপনতায় নিস্পন্দ-

সেই একবিন্দু স্থান, যা পবিত্র, আক্রমণের অতীত,
যোদ্ধার পক্ষে অদৃশ্য, মানচিত্রে চিহ্নিত নয়,
রেডিও আর হেডলাইনের বাইরে সংঘর্ষ থেকে উত্তীর্ণ-
যেখানে কিছুই ঘটে না শুধু আছে সব

সব আছে- কেননা তোমাদেরই হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়লো
ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন নিস্বনে,
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেতরেখায়-
সব অতীত, সব ভবিষ্যৎ আজ তোমাদের।

আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি জানি, বারুদ কত নিরপেক্ষ,প্রাণ কত বিপন্ন।
কাল হয়তো আগুন জ্বলবে দারুণ, হত্যা হবে লেলিহান,
যেমন আগে, অনেকবার, আমাদের মাতৃভুমি এই পৃথিবীর মৃত্তিকায়-
চাকার ঘূর্ণনের মতো পুনরাবৃত্ত।

তবু এও জানি ইতিহাস এক শৃঙ্খল, আর আমরা চাই মুক্তি,
আর মুক্তি আছে কোন পথে, বলো, চেষ্টাহীন মিলনে ছাড়া?
মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, মানুষের সঙ্গে বিশ্বের-
যার প্রমাণ, যার প্রতীক আজ তোমরা।

নাজমা, শামসুদ্দিন, আর রাত্রির বুকে লুকিয়ে-থাকা যত প্রেমিক,
যারা ভোলোনি আমাদের সনাতন চুক্তি, সমুদ্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে,
রচনা করেছো পরস্পরের বাহুর ভাঁজে আমাদের জন্য
এক স্বর্গের আভাস, অমরতায় কল্পনা :

আমি ভাবছি তোমাদের কথা আজকের দিনে, সারাক্ষণ-
সেই একটি মাত্র শিখা আমার অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে নিশান।
মনে হয় এই জগৎ-জোড়া দুর্গন্ধ আর অফুরান বিবমিষার বিরুদ্ধে
শুধু তোমরা আছো উত্তর, আর উদ্ধার।

শেয়ার করুনঃ

প্রাসঙ্গিক

নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে

ভোরের আলো এসে পড়েছে ধ্বংসস্তূপের ওপর।রেস্তোরাঁ থেকে যে ছেলেটা রোজপ্রাতরাশ সাজিয়ে দিত আমার টেবিলেরাস্তার মোড়ে তাকে দেখলাম শুয়ে আছে রক্তাপুত

বাকি অংশ »

মাতৃভূমি, কী যেন তোমার নাম ছিলো?

পাঠ্যবই থেকে অপমানে ঝরে পড়েগৌরবের পঙক্তিমালা—৭ই মার্চ প্রশ্ন করে ২৬শে মার্চকেতুমি কি শুনতে পাওজনসমুদ্রে জোয়ারের ধ্বনি?বাংলার বধির পাহাড়ওলজ্জায় নত হয়,সাগরের

বাকি অংশ »

আমার সোনার বাংলা

আমি যে দেশকে দেখি সে কি এই স্বপ্নভূমি থেকে জেগে ওঠাবহুদূরব্যাপী কল্লোলিত, সে কি রূপসনাতনসে কি আমার সোনার বাংলা, কোনো

বাকি অংশ »

সাম্প্রতিক সংযোজন

বনভূমির ছায়া

কথা ছিল তিনদিন বাদেই আমরা পিকনিকে যাব,বনভূমির ভিতরে আরও গভীর নির্জন বনে আগুন ধরাব,আমাদের সব শীত ঢেকে দেবে সূর্যাস্তের বড়

বাকি অংশ »

খিড়কি

খিড়কি ছিল পাশের বাড়িরখিড়কি ছিল মনেরখিড়কি ছিল যখন তখনখিড়কি কিছুক্ষণের । খিড়কি ছিল পথের পাশেহলুদ গাঁদাফুলের,খিড়কি ছিল আকাশ ভরামেঘের কালোচুলের

বাকি অংশ »
Scroll to Top